উপহারের ট্যাক্সেশন (Gift Tax): আয়কর আইন 56(2)(x) ধারা অনুযায়ী একটি বিস্তারিত গাইড

কল্পনা করুন, আপনার এক বন্ধু হঠাৎ আপনাকে 1 লক্ষ টাকা উপহার দিলেন কোনো বিশেষ কারণে বা বিনা কারণে। অথবা আপনি বিয়েতে আপনার এক নিকটাত্মীয় নয় এমন কারও কাছ থেকে একটি গাড়ি উপহার পেলেন। এই উপহারগুলো কি আদৌ আপনার আয় হিসেবে গণ্য হবে? কর দিতে হবে কি? এই প্রশ্নগুলোর উত্তর দেয় আয়কর আইনের ধারা 56(2)(x)

এটি আসলে একটি আলাদা ‘গিফট ট্যাক্স’ নয়, বরং এটি এমন একটি বিধান যার অধীনে নির্দিষ্ট শর্তে প্রাপ্ত কিছু উপহারকে আপনার “অন্যান্য উৎস থেকে আয়” (Income from Other Sources) হিসেবে ধরা হয় এবং তার ওপর কর ধার্য করা হয়। এই গাইডে আমরা এই আইনটিকে খুব সহজে এবং বিস্তারিতভাবে বুঝব।

কখন একটি উপহার করযোগ্য হয়?

ধারা 56(2)(x) অনুযায়ী, কোনো ব্যক্তি বা HUF (Hindu Undivided Family) কোনো আর্থিক বছরে (Financial Year – 1st এপ্রিল থেকে 31st মার্চ) নিচের যেকোনো উপায়ে সম্পদ বা নগদ অর্থ পেলে, তা করযোগ্য হতে পারে:

  1. নগদ অর্থ (Cash): কোনো ব্যক্তি বা কোম্পানির কাছ থেকে নগদ অর্থ গ্রহণ করলে।
  2. চেক বা ব্যাংক ড্রাফট (Cheque or Bank Draft): ব্যাংকের মাধ্যমে অর্থ গ্রহণ করলে।
  3. অস্থাবর সম্পত্তি (Movable Property): যেমন – শেয়ার, গয়না, গাড়ি, পেন্টিং ইত্যাদি উপহার হিসেবে পেলে।
  4. স্থাবর সম্পত্তি (Immovable Property): যেমন – ফ্ল্যাট, জমি, বাড়ি ইত্যাদি উপহার হিসেবে পেলে।

কিন্তু সব উপহারই কি করযোগ্য? না। একটি উপহার করযোগ্য হওয়ার জন্য দুটি শর্ত পূরণ করতে হয়:

  • শর্ত ১: উপহারদাতা কে? উপহারটি অবশ্যই এমন কারও কাছ থেকে আসতে হবে যিনি আইন অনুযায়ী আপনার ‘আত্মীয়’ (Relative) নন।
  • শর্ত ২: উপহারের মূল্য কত? একটি আর্থিক বছরে একজন অ-আত্মীয়ের কাছ থেকে প্রাপ্ত সমস্ত উপহারের সমষ্টিগত (Aggregate) মূল্য ₹50,000 টাকা অতিক্রম করলে তবেই তা করযোগ্য হবে।

কে এই ‘আত্মীয়’ (Relative)?

এই আইনে ‘আত্মীয়’ শব্দটির একটি নির্দিষ্ট সংজ্ঞা আছে। আপনি যদি নিচের যেকোনো ব্যক্তির কাছ থেকে উপহার পান, তবে তা করমুক্ত থাকবে, যতই বড় অঙ্কের হোক না কেন:

  1. আপনার স্ত্রী
  2. আপনার ভাই বা বোন (Brother or Sister)
  3. আপনার ভাই বা বোনের স্ত্রী/স্বামী
  4. আপনার ভাই বা বোনের সন্তান (Nephew or Niece)
  5. আপনার বা আপনার স্ত্রীর বংশধর (Descendants) – যেমন: ছেলে, মেয়ে, নাতি, নাতনি
  6. আপনার বা আপনার স্ত্রীর পূর্বপুরুষ (Ascendants) – যেমন: বাবা, মা, দাদা, দাদি, নানা, নানি
  7. আপনার বা আপনার স্ত্রীর বংশধরদের স্ত্রী/স্বামী (Spouse of a descendant) – যেমন: পুত্রবধূ, জামাই
  8. আপনার বা আপনার স্ত্রীর পূর্বপুরুষদের স্ত্রী/স্বামী (Spouse of an ascendant) – যেমন: শাশুড়ি, শ্বশুর

কারিগরি পার্শ্ব নোট: এই তালিকায় চাচা, মামা, ফুফু, মাসি, কাজিন (Cousin) ইত্যাদির নাম নেই। সুতরাং, আপনার চাচা বা মামার কাছ থেকে প্রাপ্ত উপহার সাধারণত ‘অ-আত্মীয়’ হিসেবেই বিবেচিত হবে এবং ₹50,000 এর বেশি হলে করযোগ্য হবে।

উদাহরণের মাধ্যমে বোঝা যাক

উদাহরণ ১: বন্ধুর কাছ থেকে উপহার

  • পরিস্থিতি: আপনার বন্ধু রমেশ আপনাকে 1st জানুয়ারি, 2024-এ ₹70,000 টাকা উপহার দিলেন।
  • বিশ্লেষণ:
    • উপহারদাতা আপনার আত্মীয় নন (বন্ধু)।
    • উপহারের মূল্য ₹70,000, যা ₹50,000 এর বেশি।
  • ফলাফল: পুরো ₹70,000 টাকাই আপনার “অন্যান্য উৎস থেকে আয়”-এর অধীনে যুক্ত হবে এবং আপনার আয়কর স্ল্যাব অনুযায়ী তার ওপর কর দিতে হবে।

উদাহরণ ২: একাধিক বন্ধুর কাছ থেকে উপহার

  • পরিস্থিতি: একই আর্থিক বছরে, আপনি আপনার বন্ধু রমেশের কাছ থেকে ₹30,000 এবং অন্য বন্ধু সুরেশের কাছ থেকে ₹25,000 পেলেন।
  • বিশ্লেষণ:
    • উভয়েই আপনার অ-আত্মীয়।
    • অ-আত্মীয়দের কাছ থেকে প্রাপ্ত সমষ্টিগত উপহারের মূল্য = ₹30,000 + ₹25,000 = ₹55,000।
  • ফলাফল: যেহেতু সমষ্টিগত মূল্য ₹50,000 অতিক্রম করেছে, তাই পুরো ₹55,000 টাকাই করযোগ্য হবে।

উদাহরণ ৩: ভাইয়ের কাছ থেকে উপহার

  • পরিস্থিতি: আপনার ভাই আপনাকে আপনার নতুন ব্যবসা শুরু করতে ₹2,00,000 টাকা উপহার দিলেন।
  • বিশ্লেষণ:
    • ভাই আইন অনুযায়ী আপনার ‘আত্মীয়’।
  • ফলাফল: উপহারের মূল্য যতই হোক না কেন, এটি সম্পূর্ণ করমুক্ত। আপনাকে এই টাকার জন্য কোনো কর দিতে হবে না।

যেসব ক্ষেত্রে উপহার করমুক্ত (Exemptions)

শুধুমাত্র ‘আত্মীয়’ নয়, আরও কিছু বিশেষ পরিস্থিতিতে উপহার প্রাপ্তি করমুক্ত থাকে:

  1. বিবাহের সময় প্রাপ্ত উপহার: বিবাহের অনুষ্ঠানের সময় যেকোনো ব্যক্তির (আত্মীয় বা অ-আত্মীয়) কাছ থেকে প্রাপ্ত উপহার সম্পূর্ণ করমুক্ত।
    • গুরুত্বপূর্ণ নোট: এটি শুধুমাত্র বিবাহের সময়ের জন্য প্রযোজ্য। বিবাহের আগে বা পরে প্রাপ্ত উপহারের ক্ষেত্রে এই ছাড় পাওয়া যাবে না। তবে, বিবাহের আনুষ্ঠানিকতা চলাকালীন সময়কেই বিবাবের সময় হিসেবে ধরা হয়।
  2. উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত সম্পত্তি (Inheritance): কোনো ব্যক্তির মৃত্যুর পর ইচ্ছাপত্র (Will) বা উত্তরাধিকার আইন অনুযায়ী প্রাপ্ত সম্পত্তি বা অর্থ উপহার হিসেবে বিবেচিত হয় না এবং তা সম্পূর্ণ করমুক্ত।
  3. স্থানীয় কর্তৃপক্ষ বা সরকারি সংস্থার তরফ থেকে প্রাপ্ত উপহার: কেন্দ্রীয় বা রাজ্য সরকার, কোনো স্থানীয় কর্তৃপক্ষ (যেমন পৌরসভা) বা নির্দিষ্ট কিছু প্রতিষ্ঠানের তরফ থেকে প্রাপ্ত উপহার করমুক্ত।
  4. ট্রাস্ট বা প্রতিষ্ঠান থেকে প্রাপ্ত উপহার: নির্দিষ্ট কিছু শর্ত পূরণ সাপেক্ষে, নিবন্ধিত কোনো ট্রাস্ট বা প্রতিষ্ঠানের তরফ থেকে প্রাপ্ত উপহার করমুক্ত হতে পারে।

সম্পত্তির ক্ষেত্রে কীভাবে মূল্য নির্ধারণ করা হয়?

যখন উপহার নগদ অর্থ নয়, বরং কোনো সম্পত্তি (স্থাবর বা অস্থাবর) হয়, তখন এর মূল্য নির্ধারণের নিয়ম আছে:

  • অস্থাবর সম্পত্তি (Movable Property – যেমন শেয়ার, গয়না):
    • এর ন্যায্য বাজার মূল্য (Fair Market Value – FMV) ধরা হয়।
    • তালিকাভুক্ত শেয়ারের (Listed Shares) ক্ষেত্রে, উপহার প্রাপ্তির দিনের স্টক এক্সচেঞ্জের গড় মূল্য ধরা হয়।
    • অতালিকাভুক্ত শেয়ারের (Unlisted Shares) ক্ষেত্রে, একজন মূল্যায়ন বিশেষজ্ঞের (Valuer) রিপোর্ট অনুযায়ী FMV ধরা হয়।
  • স্থাবর সম্পত্তি (Immovable Property – যেমন ফ্ল্যাট, জমি):
    • এর মূল্য নির্ধারণের জন্য দুটি জিনিসের তুলনা করা হয়:
      1. স্ট্যাম্প ডিউটি মূল্য (Stamp Duty Value): রেজিস্ট্রি অফিসে যে মূল্যে সম্পত্তির কাগজপত্র রেজিস্টার করা হয়।
      2. ন্যায্য বাজার মূল্য (FMV): সম্পত্তির প্রকৃত বাজার মূল্য।
    • এই দুইয়ের মধ্যে যেটির মূল্য বেশি, সেই মূল্যটিই উপহারের মূল্য হিসেবে ধরা হবে।
    • বিশেষ নিয়ম: যদি স্ট্যাম্প ডিউটি মূল্য, FMV-এর তুলনায় 10% বেশি হয়, তবে উক্ত অতিরিক্ত পরিমাণটুকু উপহারগ্রহীতার আয় হিসেবে গণ্য হবে (যদি তা আত্মীয় বা অন্যান্য ছাড়ের আওতায় না পড়ে)। এটি একটি জটিল নিয়ম, তাই সম্পত্তি লেনদেনের আগে একজন ট্যাক্স পরামর্শদাতার সাথে পরামর্শ করা ভালো।

টিপস ও কৌশল (Tips & Strategies)

  1. আর্থিক বছরের হিসাব রাখুন: আপনি যদি জানেন যে একজন অ-আত্মীয় আপনাকে বড় অঙ্কের উপহার দিতে চান, তবে তাকে অনুরোধ করতে পারেন যেন তিনি টাকাটা দুটি আলাদা আর্থিক বছরে দেন (যেমন, মার্চে ₹40,000 এবং এপ্রিলে ₹40,000)। এতে প্রতিটি বছরের হিসাব আলাদাভাবে হবে এবং সম্ভবত ₹50,000 এর সীমা অতিক্রম করবে না।
  2. আত্মীয়ের সুবিধা নিন: বড় লেনদেনের ক্ষেত্রে সম্ভব হলে আত্মীয়দের মাধ্যমে উপহারের ব্যবস্থা করুন। উদাহরণস্বরূপ, আপনার বাবা আপনার বন্ধুর কাছ থেকে টাকা নিয়ে আপনাকে দিলে, সেটি আপনার জন্য করমুক্ত হবে (কারণ বাবা আত্মীয়), যদিও আপনার বাবার জন্য সেই টাকা করযোগ্য হতে পারে।
  3. ডকুমেন্টেশন রাখুন: বিশেষ করে অ-আত্মীয়দের কাছ থেকে উপহার নেওয়ার সময় একটি সাধারণ গিফট ডিড (Gift Deed) বা একটি লিখিত বক্তব্য রাখুন। এতে উল্লেখ থাকা উচিত যে এটি একটি উপহার এবং এর বিনিময়ে কোনো প্রতিদান নেওয়া হচ্ছে না। এটি ভবিষ্যতে আয়কর বিভাগের কোনো প্রশ্নের উত্তর দিতে সাহায্য করবে।
  4. বিবাহের উপহারের প্রমাণ রাখুন: বিবাহের সময় প্রাপ্ত উপহারের ক্ষেত্রে বিবাহের কার্ড, ছবি বা অন্য কোনো প্রমাণ রাখা ভালো, যাতে প্রমাণ করা যায় যে উপহারটি বিবাহ অনুষ্ঠানের সময় দেওয়া হয়েছিল।

সতর্কতা (Loopholes & Cautions)

সতর্কতা: নিচের বিষয়গুলো শুধুমাত্র আইনগত দিকগুলো বোঝার জন্য। কর ফাঁকি দেওয়ার জন্য এগুলো ব্যবহার করা আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ।

  1. ‘ঋণ’ হিসেবে দেখানো: অনেকে বড় অঙ্কের লেনদেনকে উপহারের পরিবর্তে ‘ঋণ’ (Loan) হিসেবে দেখানোর চেষ্টা করেন। কিন্তু আয়কর বিভাগ এটিকে খুব কাছ থেকে দেখে। যদি কোনো ঋণ চুক্তিপত্র না থাকে, কোনো সুদ না নেওয়া হয়, বা ঋণ পরিশোধের কোনো প্রমাণ না থাকে, তবে আয়কর বিভাগ সেই ‘ঋণ’কে উপহার হিসেবে গণ্য করতে পারে এবং তার ওপর কর ধার্য করতে পারে।
  2. বেনামি লেনদেন (Benami Transactions): কেউ যদি তার নিজের নামে না রেখে অন্য কারও নামে সম্পত্তি কিনে দেয় এবং তাকে ‘উপহার’ বলে চালিয়ে দেয়, তবে তা ‘বেনামি লেনদেন’ আইনের অধীনে আসতে পারে। এটি একটি খুব গুরুতর অপরাধ এবং এর জন্য জেল এবং জরিমানা দুটোই হতে পারে। আয়কর বিভাগের কাছে এই ধরনের লেনদেনের কোনো সুরক্ষা নেই।
  3. নগদ লেনদেনের ঝুঁকি: বড় অঙ্কের নগদ লেনদেন এড়িয়ে চলুন। ব্যাংকের মাধ্যমে সমস্ত লেনদেন করুন এবং এর রেকর্ড সংরক্ষণ করুন। নগদ লেনদেনের কোনো প্রমাণ থাকে না এবং আয়কর বিভাগের কাছে এটিকে কালোটাকা হিসেবে দেখানোর ঝুঁকি থাকে।

উপসংহার

আয়কর আইনের ধারা 56(2)(x) প্রথমে জটিল মনে হলেও, এর মূল বক্তব্য খুব সহজ: অ-আত্মীয়দের কাছ থেকে প্রাপ্ত ₹50,000 এর বেশি মূল্যের উপহার করযোগ্য। আত্মীয়দের তালিকা এবং বিবাহের মতো বিশেষ ছাড়গুলো মনে রাখলে এই আইন মেনে চলা সহজ হয়ে যায়। কোনো বড় উপহার গ্রহণ বা দেওয়ার আগে একবার এই নিয়মগুলো মনে করে নিন এবং প্রয়োজনে একজন যোগ্য ট্যাক্স পরামর্শদাতার সাহায্য নিন। সঠিক জ্ঞান এবং পরিকল্পনা আপনাকে অপ্রত্যাশিত কর বোঝা থেকে রক্ষা করতে পারে।


রেফারেন্স লিঙ্ক

  1. আয়কর আইন, ১৯৬১ – ধারা 56(2)(x): আইনের প্রকৃত পাঠের জন্য।
  2. আয়কর বিভাগের অফিসিয়াল ওয়েবসাইট: সর্বশেষ বিজ্ঞপ্তি এবং নিয়মাবলীর জন্য।

দাবিত্যাগ: এই গাইডটি শুধুমাত্র তথ্যগত উদ্দেশ্যে প্রদান করা হয়েছে। এটি আইনি বা ট্যাক্স সংক্রান্ত পেশাদার পরামর্শের বিকল্প নয়। কোনো নির্দিষ্ট লেনদেনের আগে অবশ্যই একজন যোগ্য চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট বা ট্যাক্স বিশেষজ্ঞের সাথে পরামর্শ করুন।

মতামত দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রকাশ করা হবে না।