ITR-4 (Sugam) – সম্পূর্ণ গাইড বাংলায়

আজকে আমরা আলোচনা করব ITR-4 (Sugam) ফর্ম সম্পর্কে। আপনি যদি একজন ছোট ব্যবসায়ী, দোকানদার বা পেশাজীবী হন, যেমন ডাক্তার, আইনজীবী বা ফ্রিল্যান্সার, তাহলে এই ফর্মটি আপনার জন্য অনেক সুবিধাজনক হতে পারে। অনেকেই আয়কর রিটার্ন ফাইল করার কথা শুনেই ভয় পেয়ে যান, কিন্তু আসলে এটি সেই জটিল প্রক্রিয়া নয়। চলুন, খুব সহজ ভাষায় বিস্তারিত জেনে নেওয়া যাক ITR-4 (Sugam) সম্পর্কে।

ITR-4 (Sugam) কী?

ITR-4 (Sugam) হল ভারতীয় আয়কর আইনের অধীনে একটি সরলীকৃত আয়কর রিটার্ন ফর্ম। এটি মূলত সেইসব ব্যবসায়ী এবং পেশাজীবীদের জন্য তৈরি করা হয়েছে, যারা প্রেজাম্পশন ট্যাক্সেশন স্কিম (Presumptive Taxation Scheme)-এর অধীনে তাদের আয়কর রিটার্ন ফাইল করতে চান।

এখন প্রশ্ন হলো, এই প্রেজাম্পশন ট্যাক্সেশন স্কিম আসলে কী? খুব সহজ কথায়, এর মানে হলো আপনাকে আর আপনার ব্যবসার সব খরচ (যেমন: দোকান ভাড়া, কর্মচারীর বেতন, জিনিসপত্র কেনার খরচ) হিসেব করে মুনাফা বের করতে হবে না। সরকার নিজেই একটা ধরে নেয় যে, আপনার মোট ব্যবসার উপর আপনি কত শতাংশ মুনাফা করেছেন। সেই ধরে নেওয়া বা ‘প্রেজাম্পশন’-এর ওপরই আপনার ট্যাক্স ধরা হবে। এতে আপনার হিসেব-নিকেশের ঝামেলা অনেক কমে যায়।

উৎস: ইনকাম ট্যাক্স ডিপার্টমেন্ট অফিসিয়াল ওয়েবসাইট

কারা ITR-4 (Sugam) ফাইল করতে পারেন?

সবাই এই ফর্ম ব্যবহার করতে পারেন না। কিছু নির্দিষ্ট শর্ত মেনে চলতে হয়। আপনি যদি নিচের যেকোনো একটির অধীনে থাকেন, তাহলে আপনি ITR-4 ফাইল করতে পারেন:

  1. যোগ্য ব্যক্তি: কোনো ব্যক্তি (Individual), হিন্দু অবিভক্ত পরিবার (HUF) বা ফার্ম (Partnership Firm) হতে পারেন। মনে রাখবেন, কোম্পানি (Company) বা LLP এর জন্য এই ফর্মটি প্রযোজ্য নয়।
  2. আয়ের উৎস: আপনার আয় নিচের উৎসগুলি থেকে হতে পারে:
    • ব্যবসা বা পেশা (Business or Profession) – এটি হবে মূল আয়।
    • বেতন/পেনশন (Salary/Pension)
    • একটি বাড়ি থেকে আয় (Income from One House Property)
    • অন্যান্য উৎস (Income from Other Sources) – যেমন সুদ পাওয়া (লটারি বা ঘোড়দৌড় থেকে আয় বাদে)
    • কৃষি আয় (Agricultural Income) – যদি তা 5,000 টাকার কম হয়।
  3. আয়ের সীমা: আপনাকে অবশ্যই প্রেজাম্পশন ট্যাক্সেশন স্কিম বেছে নিতে হবে এবং আপনার আয়ের সীমা নিচের মতো হতে হবে:
    • ব্যবসায়ীদের জন্য: আপনার বার্ষিক মোট ব্যবসার পরিমাণ (Turnover) 2 কোটি টাকার কম হতে হবে।
    • পেশাজীবীদের জন্য: আপনার বার্ষিক মোট আয় (Gross Receipts) 50 লক্ষ টাকার কম হতে হবে।

উৎস: ITR-4 ফর্ম নির্দেশিকা

নিয়মাবলী এবং প্রবিধান

প্রেজাম্পশন স্কিমের দুটি প্রধান নিয়ম রয়েছে, যা আয়কর আইনের Section 44AD এবং Section 44ADA-এর অধীনে আসে।

1. Section 44AD – ব্যবসার জন্য

এই নিয়মটি সাধারণ ব্যবসার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য, যেমন দোকান, পাইকারি ব্যবসা, ট্রেডিং ইত্যাদি।

  • টার্নওভার সীমা: বার্ষিক টার্নওভার 2 কোটি টাকার কম হতে হবে।
  • ধরে নেওয়া আয়: আপনার মোট টার্নওভারের 8% হিসাবে আপনার আয় ধরা হবে।
  • ডিজিটাল লেনদেনের সুবিধা: যদি আপনার মোট টার্নওভারের বেশিরভাগ অংশ (বা সম্পূর্ণ) ডিজিটাল মাধ্যমে (যেমন: ব্যাঙ্ক ট্রান্সফার, UPI, কার্ড পেমেন্ট) হয়, তাহলে আপনার ধরে নেওয়া আয় হবে মাত্র 6%। সরকার ডিজিটাল লেনদেনকে উৎসাহিত করার জন্য এই সুবিধা দিয়েছে।

2. Section 44ADA – পেশার জন্য

এই নিয়মটি নির্দিষ্ট কিছু পেশার জন্য প্রযোজ্য। এই পেশাগুলি হলো: আইন, চিকিৎসা, ইঞ্জিনিয়ারিং, স্থাপত্য, হিসাবরক্ষণ, প্রযুক্তিগত পরামর্শ, অভ্যন্তরীণ সজ্জা ইত্যাদি। ফ্রিল্যান্সার হিসেবে কাজ করলেও এই নিয়মটি প্রযোজ্য হতে পারে।

  • আয় সীমা: বার্ষিক মোট আয় (Gross Receipts) 50 লক্ষ টাকার কম হতে হবে।
  • ধরে নেওয়া আয়: আপনার মোট আয়ের 50% হিসাবে আপনার আয় ধরা হবে।

গুরুত্বপূর্ণ তথ্য: এই স্কিমটি ঐচ্ছিক। আপনি চাইলে স্বাভাবিক নিয়মে (মেনে সব খরচ কেটে) আয়কর রিটার্ন ফাইল করতে পারেন। আপনাকে দেখতে হবে কোন পদ্ধতিতে আপনার কর কম হয়।

উৎস: আয়কর আইন, ১৯৬১ – সেকশন ৪৪AD এবং ৪৪ADA

ITR-4 (Sugam) এর সুবিধা ও অসুবিধা

যেকোনো স্কিমেরই কিছু ভালো এবং খারাপ দিক থাকে। চলুন দেখে নেওয়া যাক ITR-4-এর সুবিধা এবং অসুবিধা কী কী।

সুবিধা

  1. সরলীকৃত প্রক্রিয়া: এর সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো সরলতা। আপনাকে আর জটিল অ্যাকাউন্টিং বই (Profit & Loss Account, Balance Sheet) তৈরি করতে হয় না। শুধু আপনার মোট টার্নওভার বা আয় জানলেই হয়।
  2. কম কমপ্লায়েন্স: এই স্কিমের অধীনে আপনার অ্যাকাউন্টস অডিট (Tax Audit) করাতে হয় না। অডিট করাতে একজন CA (Chartered Accountant) নিয়োগ দিতে হয়, যা খরচসাপেক্ষ। এই খরচ থেকে আপনি বাঁচেন।
  3. সময় সাশ্রয়ী: হিসেব-নিকেশ কম হওয়ায় রিটার্ন ফাইল করতে অনেক কম সময় লাগে।
  4. ট্যাক্স লায়াবিলিটি আগে থেকে জানা: আপনি আগে থেকেই জানতে পারেন যে আপনাকে কত ট্যাক্স দিতে হবে, যা আর্থিক পরিকল্পনা করতে সাহায্য করে।

অসুবিধা

  1. বেশি ট্যাক্স দেওয়ার সম্ভাবনা: এটি সবচেয়ে বড় অসুবিধা। যদি আপনার আসল মুনাফা ধরে নেওয়া হারের চেয়ে কম হয়, তাহলে আপনি বেশি ট্যাক্স দিতে বাধ্য হবেন। যেমন, আপনার ব্যবসার মুনাফা যদি মাত্র 5% হয়, তাহলেও আপনাকে 8% বা 6% এর উপর ট্যাক্স দিতে হবে।
  2. খরচের ডিডাকশন পাওয়া যায় না: আপনি যতই ব্যবসায়িক খরচ (যেমন কাঁচামাল, ভাড়া, বিজ্ঞাপন) করুন না কেন, সেগুলো আলাদাভাবে দেখিয়ে ট্যাক্স বাঁচাতে পারবেন না। সরকার ধরে নেয় যে সব খরচ মিলিয়েই এই হারে আপনার মুনাফা হয়েছে।
  3. ক্ষতি ক্যারি ফরওয়ার্ড করা যায় না: যদি আপনার ব্যবসায় ক্ষতি হয়, সেই ক্ষতি পরের বছরের মুনাফার সাথে মিলিয়ে নিতে পারবেন না। স্কিমটি ধরে নেয় যে আপনি মুনাফা করেছেন, ক্ষতি করেননি।
  4. এডভান্স ট্যাক্স দেওয়া বাধ্যতামূলক: যেহেতু আপনার আয় ধরে নেওয়া হচ্ছে, সেই হিসাবে আপনাকে বছরের মধ্যেই এডভান্স ট্যাক্স দিতে হবে। সময়মতো না দিলে সুদের বোঝা বাড়তে পারে।

বাস্তব উদাহরণ

উদাহরণ দুটি দেখলে বিষয়টা আরও পরিষ্কার হবে।

উদাহরণ ১: একজন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী

অমল একজন জামাকাপড়ের দোকানদার। তার গত বছরের মোট বিক্রি বা টার্নওভার 15 লক্ষ টাকা। তার দোকান ভাড়া, কর্মচারীর বেতন এবং জামাকাপড় কেনাসহ সব মিলিয়ে খরচ হয়েছে 14 লক্ষ টাকা। সুতরাং, তার আসল মুনাফা হলো 1 লক্ষ টাকা।

  • স্বাভাবিক নিয়মে: তাকে 1 লক্ষ টাকার উপর ট্যাক্স দিতে হবে।
  • প্রেজাম্পশন স্কিমে (ITR-4): তার ধরে নেওয়া আয় হবে 15 লক্ষ টাকার 8% = 1.2 লক্ষ টাকা। তাকে 1.2 লক্ষ টাকার উপর ট্যাক্স দিতে হবে।

সিদ্ধান্ত: এক্ষেত্রে অমলের জন্য স্বাভাবিক নিয়মে ফাইল করা বেশি লাভজনক, কারণ তার আসল মুনাফার হার খুব কম।

উদাহরণ ২: একজন পেশাজীবী

সীমা একজন ফ্রিল্যান্স গ্রাফিক ডিজাইনার। তার বছরের মোট আয় 8 লক্ষ টাকা। তার ইন্টারনেট বিল, সফটওয়্যার সাবস্ক্রিপশন এবং ক্লায়েন্টের সাথে দেখা করতে ভ্রমণ মিলিয়ে খরচ হয়েছে 4 লক্ষ টাকা। তার আসল মুনাফা বা আয় হলো 4 লক্ষ টাকা।

  • স্বাভাবিক নিয়মে: তাকে 4 লক্ষ টাকার উপর ট্যাক্স দিতে হবে। এর জন্য তাকে সব খরচের রশিদ ও বিবরণ রাখতে হবে।
  • প্রেজাম্পশন স্কিমে (ITR-4): তার ধরে নেওয়া আয় হবে 8 লক্ষ টাকার 50% = 4 লক্ষ টাকা। তাকে 4 লক্ষ টাকার উপর ট্যাক্স দিতে হবে।

সিদ্ধান্ত: এক্ষেত্রে ট্যাক্সের পরিমাণ দুই ক্ষেত্রেই সমান। কিন্তু প্রেজাম্পশন স্কিমে সীমাকে 4 লক্ষ টাকার খরচের হিসেব করতে হচ্ছে না, রশিদ-বাবদের ঝামেলা নেই। তাই তার জন্য ITR-4 ফর্মটি অনেক বেশি সুবিধাজনক।

সেরা কৌশল এবং মনে রাখার বিষয়

  1. হিসাব করে দেখুন: রিটার্ন ফাইল করার আগে অবশ্যই দুটি পদ্ধতিতেই (স্বাভাবিক এবং প্রেজাম্পশন) আপনার ট্যাক্স হিসাব করে দেখুন। যেটাতে কম ট্যাক্স হয়, সেটাই বেছে নিন।
  2. ডিজিটাল লেনদেনকে অগ্রাধিকার দিন: ব্যবসায় যত বেশি ডিজিটাল লেনদেন করবেন, ততই আপনি 6% ট্যাক্সের সুবিধা পাওয়ার সুযোগ পাবেন।
  3. মৌলিক রেকর্ড রাখুন: অডিটের প্রয়োজন না হলেও, আপনাকে অবশ্যই আপনার মোট টার্নওভার বা আয়ের প্রমাণ রাখতে হবে। ব্যাঙ্ক স্টেটমেন্ট, ইনভয়েস ইত্যাদি সংরক্ষণ করুন। কর বিভাগ চাইলে এই তথ্য জমা দেওয়ার জন্য আপনাকে জিজ্ঞাসা করতে পারে।
  4. সময়মতো এডভান্স ট্যাক্স দিন: প্রেজাম্পশন আয়ের উপর এডভান্স ট্যাক্স দেওয়ার জন্য 15ই জুন, 15ই সেপ্টেম্বর, 15ই ডিসেম্বর এবং 15ই মার্চ এই তারিখগুলো মনে রাখুন। না দিলে আপনাকে সুদ (under Section 234B এবং 234C) দিতে হতে পারে।
  5. যা এড়িয়ে চলা উচিত:
    • আয় গোপন করবেন না। আপনার সম্পূর্ণ টার্নওভার সঠিকভাবে দেখান।
    • ধরে নেওয়া আয়ের উপর খরচ বাবদ কোনো ডিডাকশন দাবি করার চেষ্টা করবেন না।
    • ভুল আয়ের হেড (Business Income বা Professional Income) নির্বাচন করবেন না।

আয়কর পোর্টালের বাইরে অন্যান্য টুলস

আপনি শুধু সরকারি আয়কর পোর্টাল (www.incometax.gov.in) ব্যবহার করেই রিটার্ন ফাইল করতে পারেন, যা বিনামূল্যে। কিন্তু এর বাইরেও কিছু বিকল্প রয়েছে।

  1. ট্যাক্স ফাইলিং ওয়েবসাইট (যেমন: Clear, TaxBuddy, Quicko):
    • সুবিধা: এগুলো ব্যবহার করা খুব সহজ। স্টেপ-বাই-স্টেপ গাইডেন্স, সরল ভাষা এবং ত্রুটি খুঁজে বের করার ব্যবস্থা থাকে। প্রায় সব ক্ষেত্রেই কাস্টমার সাপোর্টও পাওয়া যায়।
    • অসুবিধা: এগুলোর ফ্রি সার্ভিসে সীমাবদ্ধতা থাকতে পারে। সম্পূর্ণ সার্ভিসের জন্য টাকা দিতে হতে পারে। তৃতীয় পক্ষের ওয়েবসাইটে ব্যক্তিগত তথ্য দেওয়ার ক্ষেত্রে অনেকে নিরাপত্তা নিয়ে ভাবতে পারেন।
  2. চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট (CA):
    • সুবিধা: আপনি পেশাদার পরামর্শ পাবেন। জটিল আর্থিক পরিস্থিতিতে CA সবচেয়ে ভালো সমাধান দিতে পারেন। কর বিভাগ থেকে কোনো নোটিস এলে তিনিই আপনার হয়ে জবাব দেবেন।
    • অসুবিধা: এটি সবচেয়ে ব্যয়বহুল বিকল্প।

উপসংহার ও পরামর্শ

ITR-4 (Sugam) ছোট ব্যবসায়ী এবং পেশাজীবীদের জন্য একটি চমৎকার উদ্যোগ। এটি আয়কর রিটার্ন ফাইল করার প্রক্রিয়াকে অনেক সহজ করে তোলে। কিন্তু মনে রাখবেন, এটি একটি ‘সুবিধার’ স্কিম, ‘ট্যাক্স বাঁচানোর’ স্কিম নয়। এটি কেবলমাত্র তখনই আপনার জন্য উপকারী, যখন আপনার আসল মুনাফার হার ধরে নেওয়া হারের কাছাকাছি বা তার বেশি হয়।

আমার শেষ পরামর্শ হলো, আয়কর নিয়ে ভয় পাবেন না। আপনার আয়-ব্যয়ের একটা সাধারণ হিসেব রাখুন এবং বছর শেষে দেখুন কোন পদ্ধতিতে আপনার জন্য সবচেয়ে ভালো হয়। সঠিক সময়ে, সঠিকভাবে রিটার্ন ফাইল করা একজন দায়িত্বশীল নাগরিকের প্রধান বৈশিষ্ট্য। নিজেকে জানুন, নিয়মগুলো জানুন এবং স্মার্টভাবে সিদ্ধান্ত নিন।

মতামত দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রকাশ করা হবে না।