ডিটিএএ (DTAA): দুই দেশ, এক কর: সম্পূর্ণ ব্যবহারিক গাইড
দুই নৌকায় পা দেওয়ার ঝুঁকি এবং ডিটিএএ-এর সমাধান
কল্পনা করুন, আপনি একজন ভারতীয় নাগরিক কিন্তু আপনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে একটি সফটওয়্যার কোম্পানিতে কাজ করেন। আপনি যে বেতন পান, তার উপর যুক্তরাষ্ট্র সরকার কর নেবে, কারণ আপনি সেখানে আয় করেছেন। একই সময়ে, যেহেতু আপনি ভারতের নাগরিক, ভারত সরকারও আপনার ওই আয়ের উপর কর দাবি করতে পারে। এটিই হল ডাবল ট্যাক্সেশন – একই আয়ের উপর দুই দেশে কর দেওয়া।
এই জটিলতার সমাধানই হল ডাবল ট্যাক্স অ্যাভয়ডেন্স এগ্রিমেন্ট (DTAA)। সহজ কথায়, DTAA হলো দুটি দেশের মধ্যে একটি চুক্তি, যার মাধ্যমে তারা ঠিক করে নেয় যে কোন দেশ কোন ধরনের আয়ের উপর কর আরোপ করবে এবং কীভাবে ডাবল ট্যাক্সেশন এড়ানো যাবে। এই গাইডে আমরা DTAA-এর ব্যবহারিক দিকগুলো জানব, যা আপনার আন্তর্জাতিক আর্থিক জীবনকে অনেক সহজ করে দেবে।
ডিটিএএ কী এবং কেন প্রয়োজন?
DTAA হলো দুই বা ততোধিক দেশের মধ্যে স্বাক্ষরিত একটি চুক্তি, যার মূল উদ্দেশ্য হলো একজন ট্যাক্সপেয়ারের উপর একই আয়ের জন্য দ্বৈত করারোপ এড়ানো। এটি বিশ্বব্যাপী ব্যবসা ও বিনিয়োগকে উৎসাহিত করে, কারণ বিনিয়োগকারীরা জানেন যে তাদের একই আয়ের জন্য দুবার কর দিতে হবে না।
আইনগত ভিত্তি (ভারতের প্রেক্ষিতে)
ভারতে, DTAA-এর আইনি ভিত্তি হলো ইনকাম ট্যাক্স অ্যাক্ট, 1961-এর সেকশন 90 এবং সেকশন 90A।
- সেকশন 90: এই সেকশনের অধীনে, ভারত সরকার অন্য কোনো দেশের সাথে DTAA স্বাক্ষর করতে পারে। যদি কোনো ভারতীয় বাসিন্দা কোনো DTAA-যুক্ত দেশে আয় করে এবং সেই আয়ের উপর কর প্রদান করে, তবে সেই করের পরিমাণ ভারতে দেওয়ার কর থেকে বাদ দেওয়া যেতে পারে।
- সেকশন 90A: এই সেকশনটি সেইসব দেশের জন্য প্রযোজ্য যাদের সাথে ভারতের DTAA নেই, কিন্তু সেই দেশটি ভারত থেকে আসা আয়ের উপর কর প্রদান করে। এক্ষেত্রেও কর ক্রেডিটের সুবিধা পাওয়া যায়।
ডিটিএএ-এর মূল স্তম্ভ ও পরিভাষা
ডিটিএএ বোঝার জন্য কিছু মূল শব্দ জানা আবশ্যক। আমি এগুলো সহজ ভাষায় ব্যাখ্যা করছি:
A. বাসিন্দা (Resident): কোনো ব্যক্তি বা কোম্পানি কোন দেশের “বাসিন্দা” হবে, তা নির্ধারণ করে সেই দেশের আইন। ভারতের ক্ষেত্রে, ইনকাম ট্যাক্স অ্যাক্ট অনুযায়ী, একজন ব্যক্তি ভারতের বাসিন্দা হবেন যদি তিনি এক আর্থিক বছরে (1st এপ্রিল থেকে 31st মার্চ) 182 দিন বা তার বেশি ভারতে থাকেন। ডিটিএএ-এর অধীনে, যে দেশের বাসিন্দা হিসেবে আপনি চিহ্নিত হবেন, সেই দেশ আপনার বিশ্বব্যাপী আয়ের উপর কর ধার্য করতে পারে।
B. স্থায়ী প্রতিষ্ঠান (Permanent Establishment – PE): এটি ব্যবসায়িক আয়ের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যদি কোনো বিদেশি কোম্পানির ভারতে একটি নির্দিষ্ট স্থানে ব্যবসার পরিচালনার জন্য স্থায়ী উপস্থিতি থাকে (যেমন: অফিস, ফ্যাক্টরি, শাখা), তবে তাকে ভারতে PE বলে গণ্য করা হয়। যদি কোনো কোম্পানির PE থাকে, তবে সেই PE-এর মাধ্যমে অর্জিত আয়ের উপর ভারত কর আরোপ করতে পারে।
C. কর রেহাইয়ের পদ্ধতি (Methods of Tax Relief): ডিটিএএ-তে ডাবল ট্যাক্স এড়ানোর জন্য মূলত দুটো পদ্ধতি থাকে:
* অব্যাহতি পদ্ধতি (Exemption Method): এই পদ্ধতিতে, একটি দেশ সম্পূর্ণরূপে কোনো নির্দিষ্ট আয়কে কর থেকে অব্যাহতি দেয়। উদাহরণস্বরূপ, যদি একজন ভারতীয় বাসিন্দা বিদেশে জাহাজে চাকরি করে আয় করেন এবং সেই দেশের সাথে ভারতের DTAA-তে এই পদ্ধতি থাকে, তবে ভারত সেই আয়ের উপর কর নাও নিতে পারে। *
ক্রেডিট পদ্ধতি (Credit Method): এটি সবচেয়ে সাধারণ পদ্ধতি। এক্ষেত্রে, উভয় দেশই আয়ের উপর কর ধার্য করে, কিন্তু যে দেশে ট্যাক্সপেয়ার বাসিন্দা, সেই দেশ অন্য দেশে প্রদত্ত করের পরিমাণকে নিজের কর থেকে ক্রেডিট হিসেবে কাটিয়ে নেয়।
**ক্রেডিট পদ্ধতির বাস্তব উদাহরণ:** * –
ধরুন, আপনি একজন ভারতীয় বাসিন্দা। আপনি যুক্তরাজ্যে থেকে কিছু পরামর্শমূলক ফি আয় করেছেন, যার পরিমাণ ₹10,00,000।
* ভারত-যুক্তরাজ্য DTAA অনুযায়ী, এই আয় যুক্তরাজ্যেও করযোগ্য এবং ভারতেও। * ধরুন, যুক্তরাজ্যে এই আয়ের উপর আপনি 20% হারে, অর্থাৎ ₹20,000 কর প্রদান করেছেন। * এখন, ভারতে এই আয় যোগ হবে আপনার মোট আয়ের সাথে এবং আপনার ট্যাক্স স্ল্যাব অনুযায়ী ধরুন কর হলো 30%, অর্থাৎ ₹30,000।
* ক্রেডিট পদ্ধতিতে, ভারতে আপনাকে যে কর দিতে হবে তা হলো: ₹30,000 (ভারতের কর) – ₹20,000 (যুক্তরাজ্যে প্রদত্ত কর) = ₹10,000। * ফলে, আপনি মোট ₹30,000 কর দিচ্ছেন, কিন্তু তার মধ্যে ₹20,000 যুক্তরাজ্যে এবং ₹10,000 ভারতে দিচ্ছেন। ডাবল ট্যাক্স হয়নি।
বিভিন্ন ধরনের আয়ের উপর ডিটিএএ-এর প্রয়োগ
ডিটিএএ বিভিন্ন ধরনের আয়ের জন্য আলাদাভাবে বিধান রাখে। এখানে কিছু প্রধান আয়ের ক্ষেত্রে ডিটিএএ-এর ব্যবহারিক প্রভাব দেখানো হলো:
সেবামূলক আয় (Income from Services):
* বেতন (Salary): যদি আপনি এক দেশের বাসিন্দা হয়ে অন্য দেশে কাজ করেন, তবে আপনার বেতন কোথায় করযোগ্য হবে তা নির্ভর করে আপনার কাজের স্থান, নিয়োগকর্তার অবস্থান এবং আপনি কোন দেশে শারীরিকভাবে উপস্থিত ছিলেন তার উপর। সাধারণত, যে দেশে আপনি কাজ করেন, সেই দেশে আপনার বেতন করযোগ্য।
* পেশাগত ফি (Professional Fees): যদি আপনি একজন স্বাধীন পরামর্শদাতা হিসেবে অন্য দেশ থেকে ফি পান, তবে সেই ফি সাধারণত আপনার বাসস্থানের দেশে করযোগ্য। তবে, যদি আপনি সেই অন্য দেশে একটি “ফিক্সড বেস” (যেমন একটি অফিস) ব্যবহার করেন এবং সেখান থেকে পরিষেবা দেন, তবে সেই দেশেও আয়ের উপর কর হতে পারে।
মূলধনী লাভ (Capital Gains): * এটি NRI-দের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যদি একজন NRI ভারতে থাকা তার সম্পত্তি (ফ্ল্যাট, শেয়ার) বিক্রি করেন, তবে সেই মূলধনী লাভের উপর কর কে দেবে? * বেশিরভাগ DTAA-তে বলা থাকে যে, সম্পত্তি যেই দেশে অবস্থিত, সেই দেশেই মূলধনী লাভের উপর কর ধার্য করা যেতে পারে। অর্থাৎ, ভারতের সম্পত্তি বিক্রি করলে মূলধনী লাভের উপর ভারতে কর দিতে হবে। * তবে, কিছু কিছু DTAA-তে (যেমন ভারত-মরিশাস DTAA) বিশেষ শর্ত আছে। যদি একজন মরিশাসের বাসিন্দা ভারতের শেয়ার বিক্রি করেন, তবে তিনি মরিশাসের বাসিন্দা হিসেবে শুধুমাত্র মরিশাসে কর দিতে পারেন, ভারতে নয়, যদি নির্দিষ্ট শর্তাবলী পূরণ করেন। এটি একটি বড় সুবিধা।
সুদ, লভ্যাংশ এবং রয়্যালটি (Interest, Dividend, and Royalty): * এই আয়গুলোর ক্ষেত্রে DTAA-এর সবচেয়ে বড় ব্যবহারিক সুবিধা হলো কম হারে উৎসে কর্তন কর (TDS – Tax Deducted at Source)। * ভারতীয় আইন অনুযায়ী, যদি কোনো ভারতীয় কোম্পানি কোনো বিদেশি বাসিন্দাকে সুদ বা রয়্যালটি প্রদান করে, তবে সেটা থেকে একটি নির্দিষ্ট হারে (যেমন সুদের ক্ষেত্রে 20%) TDS কেটে নেওয়া বাধ্যতামূলক। * কিন্তু DTAA থাকলে, সেই হার অনেক কম হয়ে যায়।
* বাস্তব উদাহরণ: ধরুন, একজন সিঙ্গাপুরের বাসিন্দা ভারতের একটি ব্যাংকে টাকা রেখে সুদ পাচ্ছেন। * DTAA না থাকলে, ভারতীয় ব্যাংক তার সুদের উপর 20% TDS কাটবে। * কিন্তু ভারত-সিঙ্গাপুর DTAA অনুযায়ী, এই হার মাত্র 10%। সুতরাং, তিনি তার TRC দেখিয়ে ব্যাংককে বলতে পারেন যে তার ক্ষেত্রে মাত্র 10% TDS প্রযোজ্য। এটিই হলো ডিটিএএ-এর সরাসরি আর্থিক সুবিধা।
ডিটিএএ-এর ব্যবহারিক দিক: কিভাবে সুবিধা নেবেন?
ডিটিএএ-এর সুবিধা পেতে হলে আপনাকে কিছু গুরুত্বপূর্ণ নথিপত্র এবং পদক্ষেপ অনুসরণ করতে হবে:
A. ট্যাক্স রেসিডেন্সি সার্টিফিকেট (Tax Residency Certificate – TRC): * এটি হলো সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নথি। আপনাকে আপনার বাসস্থানের দেশের ট্যাক্স অথরিটি থেকে একটি TRC সংগ্রহ করতে হবে। * এই সার্টিফিকেটটি প্রমাণ করে যে আপনি সেই দেশের ট্যাক্স আইন অনুযায়ী একজন বাসিন্দা। * ভারতীয় নাগরিক হিসেবে যদি আপনি বিদেশে থাকেন এবং সেই দেশের বাসিন্দা হন, তবে আপনাকে সেই দেশের ট্যাক্স অফিস থেকে TRC নিতে হবে। আর যদি আপনি একজন NRI হয়ে ভারতে আয় করেন এবং ভারতে কর ছাড় চান, তবে আপনাকে আপনার বাসস্থানের দেশের TRC ভারতীয় পেয়ার (যে আপনাকে টাকা দেবে) কে দেখাতে হবে।
রেফারেন্স: ভারতে বসবাসকারী ব্যক্তিরা ইনকাম ট্যাক্স অথরিটি থেকে ফর্ম ১০এফএ (Form 10FA) জমা দিয়ে TRC পেতে পারেন।
B. স্ব-ঘোষণাপত্র (Self-Declaration): * TRC-এর পাশাপাশি, আপনাকে সাধারণত একটি স্ব-ঘোষণাপত্র দিতে হয়, যেখানে আপনি বলবেন যে আপনি DTAA-এর অধীনে সুবিধা পাওয়ার জন্য যোগ্য। * ভারতে, এর জন্য ফর্ম ১০এফ (Form 10F) ব্যবহার করা হয়। এটি একটি ফরম্যাট যা TRC-এর সাথে জমা দিতে হয়।
C. পেয়ারকে অবহিত করা: * যদি আপনি ভারতে কোনো আয় পান (যেমন সুদ, রয়্যালটি), তবে আপনাকে আপনার TRC এবং অন্যান্য নথি আপনার পেয়ার (যেমন ব্যাংক বা কোম্পানি) কে দিয়ে ডিটিএএ-এর অধীনে কম হারে TDS কাটার জন্য অনুরোধ করতে হবে। পেয়ার আপনার নথিপত্র যাচাই করে কম হারে TDS কাটবে।
বাস্তব উদাহরণ
উদাহরণ ১: এনআরআই-এর ভারতীয় ব্যাংক থেকে সুদ আয়
- পরিস্থিতি: রাহুল, একজন ভারতীয় নাগরিক, বর্তমানে সংযুক্ত আরব আমিরাত (UAE) এর বাসিন্দা এবং সেখানে কাজ করেন। তার ভারতে একটি NRE অ্যাকাউন্ট আছে, যেখান থেকে তিনি বছরে ₹5,00,000 সুদ পান।
- ডিটিএএ ছাড়া: ভারতীয় ব্যাংক তার সুদের উপর 30.9% (TDS + Surcharge + Cess) হারে কর কেটে নেবে, যা প্রায় ₹1,54,500।
- ডিটিএএ-এর সাথে: ভারত এবং UAE-এর মধ্যে DTAA আছে। রাহুল UAE-এর ট্যাক্স অথরিটি থেকে একটি TRC সংগ্রহ করে ভারতীয় ব্যাংকে জমা দেয়। ভারত-UAE DTAA অনুযায়ী, NRE অ্যাকাউন্টের সুদের উপর কর শূন্য শতাংশ (0%)।
- ফলাফল: ব্যাংক কোনো TDS কাটবে না এবং রাহুল পুরো ₹5,00,000 সুদ পাবেন। এটি DTAA-এর একটি সরাসরি এবং বিশাল সুবিধা।
উদাহরণ ২: ভারতীয় কোম্পানির বিদেশি রয়্যালটি আয়
- পরিস্থিতি: “টেক ইন্ডিয়া লিমিটেড” একটি ভারতীয় সফটওয়্যার কোম্পানি। তারা তাদের একটি সফটওয়্যারের লাইসেন্স মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একটি কোম্পানিকে দিয়েছে এবং বছরে $10,000 রয়্যালটি পাবে।
- ডিটিএএ ছাড়া: মার্কিন কোম্পানি মার্কিন আইন অনুযায়ী 30% হারে TDS কেটে নেবে, অর্থাৎ $3,000 কেটে $7,000 দেবে। টেক ইন্ডিয়া এই $7,000 নিয়ে ভারতে আবার কর দেবে।
- ডিটিএএ-এর সাথে: ভারত-যুক্তরাষ্ট্র DTAA অনুযায়ী, রয়্যালটির উপর TDS-এর হার মাত্র 15%। টেক ইন্ডিয়া তাদের TRC এবং অন্যান্য ফর্ম (যেমন Form W-8BEN-E) মার্কিন কোম্পানিকে দেয়।
- ফলাফল: মার্কিন কোম্পানি মাত্র $1,500 (15%) TDS কেটে $8,500 প্রদান করে। টেক ইন্ডিয়া এই $8,500 নিয়ে ভারতে কর দেবে এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রদত্ত $1,500 করের জন্য ক্রেডিট দাবি করতে পারবে।
সুবিধা ও অসুবিধা (Pros and Cons)
সুবিধা (Pros):
- ডাবল ট্যাক্সেশন এড়ানো: এটি মূল উদ্দেশ্য। ট্যাক্সপেয়ারদের আর্থিক বোঝা কমায়।
- বিদেশি বিনিয়োগ বৃদ্ধি: যেহেতু বিনিয়োগকারীরা জানে যে তাদের ডাবল ট্যাক্সের ঝুঁকি নেই, তারা সহজে বিনিয়োগ করতে উৎসাহিত হয়।
- কম TDS হার: সুদ, রয়্যালটি, ফি-এর মতো আয়ের ক্ষেত্রে কম হারে TDS-এর সুবিধা পাওয়া যায়, যা নগদ প্রবাহ উন্নত করে।
- আইনি স্পষ্টতা: কোন দেশ কোন আয়ের উপর কর আরোপ করবে, তা স্পষ্ট হয়, যার ফলে বিতর্ক কমে।
অসুবিধা (Cons):
- জটিলতা: DTAA-এর ধারাগুলো আইনগতভাবে জটিল হতে পারে এবং সাধারণ মানুষের পক্ষে বোঝা কঠিন।
- প্রশাসনিক বোঝা: TRC এবং অন্যান্য নথিপত্র সংগ্রহ করা এবং পেয়ারদের সাথে যোগাযোগ করা সময়সাপেক্ষ এবং ঝামেলাপূর্ণ হতে পারে।
- ট্যাক্স ফাঁকির সুযোগ (Treaty Shopping): কিছু ব্যক্তি বা কোম্পানি অযৌক্তিকভাবে কম কর দেওয়ার জন্য DTAA-এর অপব্যবহার করে, যাকে “Treaty Shopping” বলা হয়।
ফাঁকফোকর, কৌশল এবং সতর্কতা
ডিটিএএ যতই সুগঠিত হোক না কেন, কিছু লোকে ফাঁকফোকর খুঁজে বের করে এবং সেগুলো ব্যবহার করে কর ফাঁকি দেওয়ার চেষ্টা করে। একজন সচেতন ট্যাক্সপেয়ার হিসেবে আপনার এই কৌশলগুলো জানা উচিত, যাতে আপনি অনিচ্ছাকৃতভাবে কোনো আইন ভঙ্গ না করেন বা কারও প্রতারণার শিকার না হন।
A. ট্রিটি শপিং (Treaty Shopping): কর হারের শপিং
এটি সবচেয়ে সাধারণ অপব্যবহার। এর মানে হলো, একটি দেশের বাসিন্দা হয়েও কৃত্রিমভাবে আরেকটি দেশের বাসিন্দা হওয়ার ভান করা, শুধুমাত্র সেই দেশের সাথে থাকা অনুকূল ডিটিএএ-এর সুবিধা নেওয়ার জন্য।
- বাস্তব উদাহরণ (কাল্পনিক):
- ধরুন, একজন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাসিন্দা ভারতের একটি কোম্পানিতে বিনিয়োগ করতে চান। ভারত-যুক্তরাষ্ট্র ডিটিএএ অনুযায়ী, মূলধনী লাভের উপর কর দুই দেশেই দিতে হতে পারে।
- কিন্তু, ভারত-মরিশাস ডিটিএএ অনেক বেশি অনুকূল ছিল, যেখানে মরিশাসের বাসিন্দারা ভারতে শেয়ার বিক্রি করে মূলধনী লাভ করলে তারা শুধুমাত্র মরিশাসে কর দেবে, ভারতে নয় (যদি নির্দিষ্ট শর্ত পূরণ করে)।
- এই সুবিধা নেওয়ার জন্য, ওই মার্কিন বিনিয়োগকারী মরিশাসে একটি কাগজে-কলমে কোম্পানি (shell company) খুলে সেই কোম্পানির মাধ্যমে ভারতে বিনিয়োগ করলেন। তার কোনো আসল ব্যবসা বা অফিস মরিশাসে নেই। এটিই হলো ট্রিটি শপিং।
- ফলাফল: তিনি ভারতে কর এড়িয়ে গেলেন, যা আসলে ডিটিএএ-এর মূল উদ্দেশ্যের পরিপন্থী।
B. অ্যান্টি-অ্যাবিউজ ক্লজ (Anti-Abuse Clauses): ফাঁকফোকর বন্ধ করার ব্যবস্থা
এই ধরনের অপব্যবহার রোধ করার জন্য আধুনিক ডিটিএএ-তে কিছু শক্তিশালী ধারা যোগ করা হচ্ছে:
- লিমিটেশন অন বেনিফিটস (Limitation on Benefits – LOB): এই ধারাটা ডিটিএএ-এর সুবিধা পাওয়ার জন্য কিছু কঠোর শর্ত আরোপ করে। উদাহরণস্বরূপ, একটি কোম্পানিকে সুবিধা পেতে হলে তাকে প্রমাণ করতে হবে যে সেই দেশের একটি আসল ব্যবসা আছে, শুধু কর ফাঁকি দেওয়ার জন্য নয়।
- প্রিন্সিপাল পারপাস টেস্ট (Principal Purpose Test – PPT): এটি আরও বেশি কার্যকর। এই টেস্ট অনুযায়ী, যদি কোনো লেনদেনের মূল উদ্দেশ্য বা অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য ডিটিএএ-এর সুবিধা ভোগ করা হয়, তবে সেই লেনদেনের ক্ষেত্রে ডিটিএএ-এর সুবিধা দেওয়া হবে না। অর্থাৎ, ট্যাক্স অথরিটি জিজ্ঞাসা করতে পারে, “আপনি কেন এই জটিল কাঠামো ব্যবহার করছেন? এর মূল উদ্দেশ্য কি কর বাঁচানো?” যদি উত্তর ‘হ্যাঁ’ হয়, তবে সুবিধা বাতিল হয়ে যাবে।
কৌশল হিসেবে সতর্কতা: যদিও এই ফাঁকফোকরগুলো আকর্ষণীয় মনে হতে পারে, কিন্তু এগুলো ব্যবহার করা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। বিশ্বব্যাপী ট্যাক্স অথরিটিগুলো (যেমন ভারতের আয়কর বিভাগ) এখন খুবই সতর্ক এবং এই ধরনের কাঠামোকে চ্যালেঞ্জ করছে। জরিমানা ও আইনি জটিলতার ঝুঁকি থাকে।
সাধারণ মানুষের জন্য ব্যবহারিক টিপস
আপনাদের জন্য কিছু খুব সাধারণ কিন্তু কার্যকরী টিপস দিচ্ছি, যা ডিটিএএ-এর সুবিধা নিতে আপনাকে সাহায্য করবে:
A. ডিটিএএ আছে কিনা যাচাই করুন: কোনো দেশ থেকে আয় পাওয়ার আগে বা সেখানে বিনিয়োগ করার আগে, প্রথমে যাচাই করে নিন যে ভারতের সাথে সেই দেশের ডিটিএএ আছে কিনা। ভারতের আয়কর দপ্তরের ওয়েবসাইটে এর তালিকা পাওয়া যায়।
B. TRC হলো আপনার ‘সোনার টিকিট’: আপনার বাসস্থানের দেশের TRC ছাড়া আপনি ডিটিএএ-এর সুবিধা পাবেন না। এটি আগে থেকেই সংগ্রহ করে রাখুন। TRC পেতে কিছুটা সময় লাগতে পারে, তাই শেষ মুহূর্তের জন্য অপেক্ষা করবেন না।
C. কাগজপত্র ঠিক রাখুন: TRC, ফর্ম ১০এফ, চুক্তিপত্র, পেমেন্ট প্রুফ – সবকিছু সুন্দরভাবে সংরক্ষণ করুন। ট্যাক্স অথরিটি যেকোনো সময় এই নথিপত্র চাইতে পারে।
D. আপনার আয়ের ধরন বুঝুন: আপনার আয়টা কী ধরনের? সেটা কি বেতন, পেশাগত ফি, সুদ, নাকি মূলধনী লাভ? ডিটিএএ-তে প্রতিটা আয়ের জন্য আলাদা বিধান আছে। ভুল ধরনের আয় হিসেবে দাবি করলে আপনি সমস্যায় পড়তে পারেন।
E. পেয়ারকে সঠিক তথ্য দিন: যদি আপনি ভারতে কোনো পেমেন্ট পান, তবে আপনার পেয়ারকে (যে ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান আপনাকে টাকা দেবে) আপনার TRC এবং অন্যান্য ফর্ম সময়মতো দিন। এতে তারা সঠিক হারে TDS কাটতে পারবে এবং আপনাকে পরে রিফান্ডের ঝামেলা পোহাতে হবে না।
F. সন্দেহ হলে বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিন: ডিটিএএ একটি জটিল বিষয়। যদি আপনার লেনদেনটি বড় হয় বা আপনি নিশ্চিত না হন, তবে একজন ভালো ট্যাক্স কনসালট্যান্ট বা চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্টের (CA) পরামর্শ নেওয়া সবচেয়ে ভালো। একটু খরচ করে পরবর্তী বড় আর্থিক ক্ষতি এবং আইনি ঝামেলা থেকে বাঁচতে পারেন।
ডিটিএএ-এর ভবিষ্যৎ
ডিটিএএ একটি স্থির চুক্তি নয়; এটি ক্রমাগত বিবর্তিত হচ্ছে। বিশ্বব্যাপী কর ফাঁকি রোধ করার জন্য দেশগুলো একসাথে কাজ করছে।
- BEPS (Base Erosion and Profit Shifting): অর্থনৈতিক সহযোগিতা ও উন্নয়ন সংস্থা (OECD) এবং G20 দেশগুলো BEPS নামে একটি প্রকল্প চালু করেছে। এর লক্ষ্য হলো বহুজাতিক কোম্পানিগুলোকে লাভকে কর-কম দেশে (tax havens) স্থানান্তরিত করে কর ফাঁকি দেওয়া থেকে বিরত রাখা।
- মাল্টিল্যাটারেল ইনস্ট্রুমেন্ট (MLI): BEPS-এর ফলস্বরূপ, MLI নামে একটি চুক্তি তৈরি হয়েছে। এর মাধ্যমে অনেকগুলো দেশ একসাথে তাদের বিদ্যমান ডিটিএএ-গুলোকে দ্রুত সংশোধন করতে পারে, যাতে PPT এবং LOB-এর মতো অ্যান্টি-অ্যাবিউজ ক্লজ যোগ করা যায়। ভারতও MLI-এর অংশ।
ভবিষ্যতে, ডিটিএএ-এর সুবিধা পাওয়া আরও কঠিন হবে এবং আরও বেশি স্বচ্ছতা ও যথাযথতার প্রমাণ দাবি করা হবে।
উপসংহার: ডিটিএএ – একটি শক্তিশালী ঢাল, তলোয়ার নয়
ডাবল ট্যাক্স অ্যাভয়ডেন্স এগ্রিমেন্ট (DTAA) হলো একটি শক্তিশালী ঢাল, যা একজন বিশ্বব্যাপী ট্যাক্সপেয়ারকে দ্বৈত করারোপের অন্যায় বোঝা থেকে রক্ষা করে। এটি আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ও বিনিয়োগের জন্য একটি ন্যায্য ও স্বচ্ছ পরিবেশ তৈরি করে।
তবে, মনে রাখবেন, ডিটিএএ হলো কর ফাঁকি দেওয়ার একটি হাতিয়ার নয়। এর উদ্দেশ্য হলো ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা, নয় কর এড়ানো। এর সুবিধা নিতে হলে আপনাকে অবশ্যই সঠিক নথিপত্র, স্বচ্ছতা এবং আইনের প্রতি শ্রদ্ধা বজায় রাখতে হবে।
এই গাইডটি আপনাকে ডিটিএএ-এর জটিল জগতে একটি মানচিত্র তুলে দেওয়ার জন্য তৈরি করা হয়েছে। এই জ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে, আপনি আন্তর্জাতিক আর্থিক লেনদেনগুলো আরও আত্মবিশ্বাসের সাথে পরিচালনা করতে পারবেন এবং নিশ্চিত হতে পারবেন যে আপনি আইন মেনেই সঠিক সুবিধাটি পাচ্ছেন। স্মার্টভাবে কর পরিকল্পনা করুন, আইন মেনে চলুন, এবং বিশ্বব্যাপী আপনার আর্থিক যাত্রাকে সফল করে তুলুন।
মতামত দিন